'ফিল্ম নয়ার' শব্দটি সিনেমাপ্রেমীদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা ও গবেষণার বিষয় হয়ে আছে। এই ধারার ইতিহাস শুরু হয় ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে, যেখানে আমেরিকান অপরাধধর্মী নাটক, ফরাসি কবিতার মতো বাস্তবধর্মী সিনেমা এবং জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের প্রভাব একত্রিত হয়ে একটি নতুন ঘরানার জন্ম দেয়। এই সময়টিকে ফিল্ম নয়ারের 'ক্লাসিক যুগ' (১৯৪০-১৯৫০) বলা হয়।
'ফিল্ম নয়ার' অর্থ 'কালো চলচ্চিত্র'—এই শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৩৮ সালে ফ্রাঁসোয়া ভিনোয়েল নামের এক সমালোচকের লেখায় এবং পরে ১৯৪৬ সালে নিনো ফ্র্যাঙ্ক নামের একজন বিশ্লেষক এটি জনপ্রিয় করেন, যখন তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সে মুক্তিপ্রাপ্ত কিছু আমেরিকান সিনেমা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এই সিনেমাগুলোর মধ্যে দ্য মাল্টিজ ফ্যালকন (১৯৪১), আউট অব দ্য পাস্ট (১৯৪৭) এবং ইন আ লোনলি প্লেস (১৯৫০) উল্লেখযোগ্য, যেগুলো ফিল্ম নয়ার ঘরানাকে সংজ্ঞায়িত করে।
এই লেখায় কালজয়ী ১০টি নয়ার চলচ্চিত্র সম্পর্কে তুলে ধরা হলো—
ওটো প্রিমিঙ্গার পরিচালিত 'লরা' আজও সর্বকালের অন্যতম সেরা ও রহস্যময় চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত। রহস্য, প্রেম আর অন্ধ আবেগের এক অনবদ্য মিশেল এই ছবি। কেন্দ্রীয় চরিত্র লরা হান্ট (জিন টিয়ার্নি), একজন সফল বিজ্ঞাপনকর্মী, যার খুনের তদন্তে নামে গোয়েন্দা মার্ক ম্যাকফারসন (ডানা অ্যানড্রুজ)। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে ম্যাকফারসন নিজেই ধীরে ধীরে নিহত লরার প্রতি গভীরভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে।
প্রিমিঙ্গার গল্পটিকে সাজিয়েছেন একদিকে যেমন রহস্য ও প্রেম দিয়ে, তেমনি মানুষের আবেগ ও অবচেতনের গভীরতা দিয়েও। ডেভিড রাকসিনের সুর এবং জোসেফ লা শেলের ক্যামেরার কাজ ছবির আবহকে করে তোলে আরও মনোমুগ্ধকর। ক্লিফটন ওয়েবের স্মরণীয় পারফরম্যান্স এই ছবিকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। লরা শুধু একটি রহস্য গল্প নয়, এটি এক বিস্ময়কর আবেগের ভেতর প্রবেশের টিকিট।
বিলি ওয়াইল্ডার পরিচালিত 'সানসেট বুলেভার্ড' শুধু একটি চলচ্চিত্রই নয়, বরং হলিউডের অন্ধকার দিক নিয়ে নির্মিত একটি শক্তিশালী সমালোচনাও। গ্লোরিয়া সুয়ানসন অভিনীত নর্মা ডেসমন্ড চরিত্রটি সিনেমার ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে—এক সময়ের বিখ্যাত নীরব চলচ্চিত্র তারকা, যিনি খ্যাতির মোহে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। তার বিখ্যাত সংলাপ, 'ওকে, মি. ডি মিল, আই অ্যাম রেডি ফর মাই ক্লোজ-আপ,' আজও দর্শকদের কাঁপিয়ে তোলে।
উইলিয়াম হোলডেনের চরিত্র, জো গিলিস, একজন হতাশ চিত্রনাট্যকার, যিনি নর্মার অস্থির মানসিক জগতে জড়িয়ে পড়েন। ওয়াইল্ডারের পরিচালনা এবং তীক্ষ্ণ চিত্রনাট্য হলিউডের মোহ ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা নিয়ে তৈরি করে এক চিরকালীন চলচ্চিত্র। 'সানসেট বুলেভার্ড' আজও এক কালজয়ী শিল্পকর্ম এবং ফিল্ম নয়ার ঘরানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
'দ্য বিগ কম্বো' দেখায় কীভাবে ফিল্ম নয়ার তার অন্ধকার ভাবনার মধ্য দিয়েই আশার খোঁজ করে। পুলিশের লেফটেন্যান্ট লিওনার্ড ডায়মন্ডের (করনেল ওয়াইল্ড) প্রধান লক্ষ্য হলো ভয়ংকর গ্যাংস্টার ব্রাউনকে (রিচার্ড কন্টে) ধরা। ব্রাউন বারবার খুন করে পার পেয়ে যায় এবং ডায়মন্ডকে এমন এক মানসিক অবস্থায় নিয়ে যায়, যেখানে সে নিজেই নিজের মূল্যবোধ ও আত্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন করে।
ডায়মন্ডের এই আত্মসংঘর্ষ, নিজের দুর্বলতা ও ভয়ের মুখোমুখি হওয়া এবং ভালোবাসার প্রয়োজন—এসব বিষয় সিনেমাটিকে এক মানবিক রূপ দেয়। পরিচালক জোসেফ এইচ লুইস ও সিনেমাটোগ্রাফার জন অল্টনের যুগলবন্দি ছবিটিকে করে তোলে অত্যন্ত দর্শনীয় ও আবেগময়। 'দ্য বিগ কম্বো' নিছক একটি অপরাধচিত্র নয়—এটি মানবিক লড়াই ও আত্ম-অন্বেষণের এক রূপক।
'ডাবল ইনডেমনিটি' এমন একটি চলচ্চিত্র যা টানটান উত্তেজনা, লোভ ও নৈতিক সংকটকে অসাধারণ দক্ষতায় তুলে ধরে। এখানে ফ্রেড ম্যাকমারেই অভিনীত ওয়াল্টার নেফ, একজন বিমা বিক্রেতা, জড়িয়ে পড়েন বারবারা স্ট্যানউইকের চরিত্র, ফিলিস ডাইট্রিচসনের এক মরণফাঁদে। ফিলিস একজন ক্লাসিক 'ফেম ফ্যাটালে'—সুন্দরী, চতুর ও ভয়ানক।
বিলি ওয়াইল্ডারের নির্দেশনা ও বিখ্যাত লেখক রেমন্ড চ্যান্ডলারের চিত্রনাট্য এই ছবিকে করে তোলে এক নিখুঁত নয়ার ক্লাসিক। এর সংলাপ, চরিত্র ও মোড় ঘোরা কাহিনি এতটাই শক্তিশালী যে ডাবল ইনডেমনিটি আজও আধুনিক থ্রিলার ও নয়ার ধারার পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত হয়।
'আইভি' একটি ব্যতিক্রমী নয়ার চলচ্চিত্র, কারণ এটি সংঘটিত হয় ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে—যেখানে বেশিরভাগ নয়ার গল্প হয় আধুনিক শহরকেন্দ্রিক। কেন্দ্রীয় চরিত্র আইভি লেক্সটন (জোয়ান ফন্টেইন) এক ধূর্ত নারী, যার বাহ্যিক সৌন্দর্য ও সৌজন্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর উচ্চাকাঙ্ক্ষা।
আইভি তার প্রেমিকদের প্রতারণা ও হত্যার মাধ্যমে সমাজে নিজের অবস্থান শক্ত করতে চায়। সিনেমাটির আলোকসজ্জা, পোশাক ও সেট ডিজাইন অত্যন্ত আকর্ষণীয়—এবং এই সৌন্দর্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নিষ্ঠুরতা ছবিটিকে করে তোলে আরও গভীর ও প্রভাবশালী। ফন্টেইনের অনবদ্য অভিনয় ও চরিত্রের জটিলতা 'আইভি'-কে ফিল্ম নয়ার ঘরানার একটি দুর্লভ রত্নে পরিণত করেছে।
'দ্য থার্ড ম্যান' পরিচালনা করেছেন ক্যারল রিড এবং এটি পোস্ট-ওয়ার ভিয়েনার প্রেক্ষাপটে নির্মিত একটি দারুণ রহস্যধর্মী সিনেমা। এখানে লেখক হোলি মার্টিনস (জোসেফ কটেন) তার পুরোনো বন্ধু হ্যারি লাইমের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন গভীর ষড়যন্ত্রে।
অরসন ওয়েলস অভিনীত হ্যারি লাইম চরিত্রটি সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় একটি চরিত্র। ছবির আবহসংগীতে ব্যবহৃত যিথার সুর, কেমরার কৌণিক গঠন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সমাজের অস্থিরতা একত্রে তৈরি করে একটি চিরকালীন শৈল্পিক রচনা। দ্য থার্ড ম্যান শুধু একটি রহস্য নয়, বরং এক দার্শনিক অনুসন্ধান মানবিক সংকট নিয়ে।
'লিভ হার টু হেভেন' ফিল্ম নয়ারের মাঝে এক ব্যতিক্রম—এটি রঙিন সিনেমা এবং দৃশ্যত এক মনোমুগ্ধকর গল্প। কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অসুস্থ প্রেম ও নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা। জিন টিয়ার্নির অভিনীত এলেন বেরেন্ট, একজন সুন্দরী ও অভিজাত নারী, যিনি নিজের ভালোবাসার মানুষকে কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান না। তার এই প্রবল অধিকারবোধ ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পরিচালক জন এম স্টল এই সিনেমাকে দিয়েছেন একটি মেলোড্রামার ছোঁয়া, যেখানে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা ও আবেগে ভরা চরিত্র নির্মিত হয়েছে অসাধারণ দক্ষতায়। এই ছবিটি প্রমাণ করে, ফিল্ম নয়ার শুধুই অন্ধকার গলি বা অপরাধ নয়—এটি মানুষের ভেতরের ভয়ংকর আবেগগুলোকেও তুলে ধরতে পারে।
'হোয়ার দ্য সাইডওয়াক এন্ডস' আরেকটি প্রিমিঙ্গার পরিচালিত চলচ্চিত্র, যেখানে ডানা অ্যান্ড্রুজ আবারও গোয়েন্দা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু এবার তার চরিত্র আরও জটিল—একজন পুলিশ অফিসার, যিনি নিজের সহিংস প্রবৃত্তির সঙ্গে লড়াই করছেন।
একজন সন্দেহভাজনকে দুর্ঘটনাবশত হত্যা করার পর, তিনি সত্য লুকাতে গিয়ে নিজের নৈতিকতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দোটানায় পড়েন। জিন টিয়ার্নির চরিত্র এখানে প্রেম ও সহানুভূতির প্রতীক হয়ে উঠে আসে।
এই সিনেমা আলো ও অন্ধকারের খেলা শুধু বাইরের জগতে নয়, মানুষের ভেতরেও কীভাবে ঘটে—সেই কথা বলে। নৈতিকতা, অপরাধবোধ ও পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই ছবি এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক চিত্রায়ন।
নিকোলাস রে পরিচালিত 'অন ডেঞ্জারাস গ্রাউন্ড' একটি ভিন্নধর্মী নয়ার—কারণ এটি শহরের অন্ধকার গলি থেকে না গিয়ে নিয়ে যায় বরফে ঢাকা গ্রামীণ এক পরিবেশে। পুলিশ অফিসার জিম উইলসন (রবার্ট রায়ান) শহরের সহিংস পরিবেশে ক্লান্ত হয়ে যান এবং পরে গ্রামে গিয়ে মেরি মলডেন (আইডা লুপিনো) নামের এক অন্ধ নারীর সঙ্গে দেখা হয়।
মেরির কোমলতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি উইলসনের ভেতরের ক্ষোভ ও হতাশাকে বদলে দেয়। এই সিনেমা অপরাধ ও প্রায়শ্চিত্ত—উভয়ের কাহিনি। বরফে ঢাকা প্রাকৃতিক পরিবেশ যেন চরিত্রের ভেতরের পবিত্রতার প্রতীক। এটি এক মন-ছোঁয়া ফিল্ম নয়ার, যেখানে সহানুভূতি রয়েছে, অন্ধকারের মধ্যেও।
'ডিটুর' এমন এক চলচ্চিত্র যা অল্প বাজেটের মধ্যেও কীভাবে এক চমৎকার ফিল্ম নয়ার তৈরি করা যায়—তার উদাহরণ। আল রবার্টস (টম নিল), এক সাধারণ পিয়ানোবাদক, যিনি নিউইয়র্ক থেকে হলিউডে যাওয়ার পথে এক ভয়ংকর ঘটনার শিকার হন। তার সঙ্গে ঘটে হত্যা, মিথ্যা পরিচয় আর ফাঁদে পড়ার এক দুঃস্বপ্ন।
ভেরা চরিত্রে অ্যান স্যাভেজ একেবারে ভয়ংকর বাস্তববাদী—আবেগশূন্য, নির্মম ও বেপরোয়া। পরিচালক এডগার জি উলমার এক লাখ ডলারেরও কম বাজেটে এই সিনেমা বানিয়েছেন। কিন্তু সীমিত সংস্থানেই তিনি এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছেন, যা আজও দর্শকদের মনে গেঁথে থাকে। 'ডিটুর' দেখায়, ফিল্ম নয়ার মানে বাজেট নয়—বরং ভাবনার গভীরতা ও গল্প বলার মুন্সিয়ানা।
পাঠকের মন্তব্য
আপনার মতামত দিন
সাম্প্রতিক মন্তব্য (১)
সাকিব আহমেদ
২ দিন আগেখুব গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক প্রতিফলন দেখা গেছে। ধন্যবাদ!