'মনে হয় সমাবৃত হয়ে আছি কোন্ এক অন্ধকার ঘরে/ দেয়ালের কর্নিশে মক্ষিকারা স্থিরভাবে জানে/ এইসব মানুষেরা নিশ্চয়তা হারায়েছে নক্ষত্রের দোষে/ পাঁচ ফুট জমিনের শিষ্টতায় মাথা পেতে রেখেছে আপসে।'
জীবনানন্দ দাশের 'মনোসরণি' কবিতাটি শুরু হয় এই লাইনগুলো দিয়ে। এই কবিতার নামটি থেকেই একসময় জন্ম নিয়েছিল বাংলা ব্যান্ড 'মনোসরণি'। সেটা ২০০৪ সালের কথা। দুই কবি প্রবর রিপন ও মুয়ীয মাহফুজ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। কবিতার সূত্রেই পরিচয়, সেখান থেকে গান করার ভাবনা। 'মনোসরণি'-র গানে তারা তুলে আনতে চেয়েছিলেন মানুষের অস্তিত্ব, মনোজগতের পুনর্বিন্যাস, আমাদের চারপাশ।
২০১৩ সালে, আজ থেকে এক যুগ আগে তাদের সেলফ টাইটেলড অ্যালবাম 'মনোসরণি' প্রকাশিত হয়। মনোসরণির কার্যকাল ছিল ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। ব্যান্ডটি এখন নেই, তবে তাদের গানগুলো আছে। সেসব গান বাংলা গানকে বহুভাবে সমৃদ্ধ করেছে। ব্যান্ডটির সদস্য ছিলেন প্রবর রিপন (ভোকাল ও গিটার), মুয়ীয মাহফুজ (ভোকাল ও গিটার), প্রসূন (বেজ) ও বাঁধন (ড্রামস)।
তাদের গানগুলোর কথার দিকে একটু খেয়াল করলেই তাদের নামকরণের সার্থকতা মূর্ত হয়ে ওঠে। 'আমি আর এক মাকড়সা এই ঘরে থাকি/ দুজনে মিলে স্বপ্নের জাল বুনে যাই/ দেহের গুহায় ওড়ে মায়ার পাখি/ চোখের দেয়ালে কাঁপে খাঁচার ছায়া/ সারারাত শিয়রে জ্বলে মোমের আগুন/ গলে গলে জড়ো হই আবার পোড়ার আশায়/ স্বপ্নের আকাশে ওড়ে জাতিস্মর শকুন/ মায়ার পৃথিবীর তন্তু ছেড়ে হৃদয়ের আভায়'—প্রবর রিপনের লেখা ও সুরে 'নির্জন অভয়ারণ্য' নামের এই গানটি তারই গাওয়া। শুরুটাই হয় বেশ সাইকেডেলিক একটা ফ্লেভারে। এই গান আমাদের ভেতরের শূন্যতাকে যেমন তুলে ধরে, তেমনি তুলে ধরে আমাদের মরীচিকাময় জীবনকেও। মাকড়সা জাল বোনে শিকারের আশায়, কিন্তু সে-ও কি শিল্পী নয়? তার বোনা জাল কারো কাছে ফাঁদ, কিন্তু তার কাছে তো নিপুণ শিল্পই। কিংবা 'জাতিস্মর শকুন'- সে কি পূর্বজন্মের পরম্পরা রক্ষা করে বারবার নিজের ধাঙড় পরিচয়টিকেই বয়ে নিয়ে চলছে না?
অ্যালবামের দ্বিতীয় গান 'তোমাকে ছাড়া'-র লেখা, সুর ও কণ্ঠ মুয়ীয মাহফুজের। 'রাত্রি গভীর পালাতে হবে/ পেছনে খুনিরা, সামনে যাব, তবু পিছু হটে যাই/ তোমাকে ছাড়া কি একা বাঁচা যায়, বলো একা বাঁচা যায়/ চুপচাপ থাকো, শব্দ কোরো না/ কথা বললে আর ফুল ফুটবে না/ একটু জোরে হাঁটো না...'—ব্লুজ ধাঁচে করা এই গানটিতে আমরা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই৷ বিদ্রোহ, প্রেম, পিছুটান, পলায়নপরতা—সব একাকার হয়ে মিশে যায় গানটিতে। সৌন্দর্যের জন্য, সুন্দর সৃষ্টির জন্য বেছে নেওয়া যে আপাত নিরাপদ জীবন—সেই জীবনের হিরণ্ময় নীরবতার মাঝে একটু শব্দও কি ঘটাতে পারে না ছন্দপতন, তছনছ করে দিতে পারে না সবকিছু?
প্রবর রিপনের কথা, সুর ও কণ্ঠে অ্যালবামের তৃতীয় গান 'মানুষ না ক্রীতদাস' এই ক্যাসেটের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী লিরিক। 'আমি কি বলতে পারি এই প্রিয়তমা ঠিক আমারই?/ আর যে হাতিয়ারে হচ্ছে আমারই শিরশ্ছেদ, তা আমারই হাতে গড়া?/ আমি কোন্ প্রজাতি - মানুষ না ক্রীতদাস?'—গানের এই কথাগুলো আমাদের সেই চিরন্তন প্রশ্নেরই সম্মুখীন করে যে, আমরা আসলেই কতটুকু এগোলাম? সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ আসলে তার মর্যাদা বা মানবিকতা—কিছুই ধরে রাখতে পারছে না৷ কারণ, তাকে হতে হয়েছে দুর্বৃত্তায়িত ব্যবস্থার অংশ। তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে পুঁজি, আর তাদের প্রভু হয়ে উঠেছে তারই মতো দেখতে কিছু 'মানুষ', যাদের আজ্ঞাবহ হয়েই কেটে যাচ্ছে তার জীবন!
চতুর্থ গান 'রামপাম' মুয়ীয মাহফুজের লেখা, সুর ও গাওয়া। 'আমার যা আছে তা দেখেও না দেখো/ আমার যা নেই তাই বড় করে দেখো/ আঁধারে আতশ কাচে কী খোঁজো তুমি/ জীবন বিহীন এক জ্ঞানী মরুভূমি/ আমার যা আছে তা আজ কাছে নেই/ আজ কাছে আছে তবুও কাল কাছে নেই/ তোমার যাকে দরকার সে তো হারিয়ে গেছে/ কোথাও পাবে না যাকে সে তোমারি পিছে'—আবারও আমাদের সেই নিরন্তর ছুটে চলা, পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলানো আর নিজেদের খুঁজে ফেরা। কিন্তু নিজেদের কি খুঁজে পাওয়া যায়? যায় না। এভাবেই পরশপাথরের সন্ধানে আমাদের জীবন পেরিয়ে যায়।
অ্যালবামের অন্যান্য গানগুলোও এরকম গভীর জীবন দর্শন প্রকাশ করে। প্রবর রিপনের গাওয়া 'মা-কে লেখা চিঠি'-তে যেমন আমরা শুনতে পাই, 'মা, আমার একটা ছাতার দরকার/ বাইরে প্রখর রোদ আর ভেতরে ভীষণ শিলাবৃষ্টি/ ছাতার আশ্রয়ে বাইরে না হয় রুখি/ তবে ভেতরটা হবে কী করে সুখী?'—নিরাপত্তার প্রতি আমাদের সেই চিরন্তন আবেদন, সেই চিরায়ত আশ্রয়—যার নাম 'মা'। আর সেই 'মা'-র কাছেই এভাবে সংকটে ছুটে যায় মানুষ।
আবার তারই গাওয়া 'মৌন মন্দির' গানটির সেই কথাগুলো—'আঘাতের আশ্বাসে আমরা ভালোবাসি/ বাগানে নেই গানের পাখি/ বাজে শুধু কাঁটার বাঁশি'—আমাদের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস হারাতে দেয় না। বরং ভালোবাসার দিকেই বারবার আমরা ফিরে যাই, আমরা আঘাত পাই, বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা বহন করি; তবুও দিনশেষে ভালোবাসি।
আবার নিজেদের জন্য একটা আশ্রয়, একটা ঠিকানার সন্ধান পাওয়ার তাড়না আমরা দেখি মুয়ীয মাহফুজের গাওয়া 'হোমসিক' গানটিতে। শহীদ কাদরীর 'সঙ্গতি' কবিতার 'প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিকই/ কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না'—লাইনগুলোও এসেছে গানটির কথায়। 'ঘরে বসে আজও হয়তো গড়েছিলে কাগজের নৌকো/ ভাসাবার জন্য কিছুটা জল না পেয়ে ভেবেছ নদী তোমার প্রিয়/ আমি বলি সব দৃশ্য একা দেখাই শ্রেয়/ আমি বলি সব দৃশ্য একা দেখাই শ্রেয়।' আমরা দিনশেষে আর কারো কাছে নির্ভরতা না খুঁজে নিজেই নিজেদের বন্ধু ও ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারি।
প্রবর রিপনের কণ্ঠেই 'তোমাকে খুঁজেছি'-তে আমরা শুনি 'হৃদয়ে থেকে হৃদয়ে তাই, কত জন্মের অপরিণয়/ অসীম সেই মৃত্যুতে বুঝি শোধ হবে নির্বাসনের সময়?'—এই লাইনগুলো আমাদের এমন এক অনুভূতির সম্মুখীন করে, যার মুখোমুখি আমরা খুব সহজে হতে পারি না। কিন্তু এই অনুভূতিকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এটা সঙ্গে থেকেই যায়।
'জীবন মানে গরমিল', 'জন্মান্ধের কানামাছি খেলা' ও 'সুদর্শন রোবট' এর মতো গানগুলোও আমাদের অস্তিত্বের লড়াই, সংকট ও সংবেদনশীলতা ধরে রাখার নিরন্তর লড়াই নিয়েই কথা বলে।
একেবারে শেষে আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় অ্যালবামের নবম গান 'আত্মজীবনী'-র কথা। প্রবর রিপনের লেখা একই নামের মূল কবিতাটি অবলম্বনে এই গানটি তারই গাওয়া। 'যে কথা আমি নিজে বলতে পারিনি তোমাকে/ সেই কথা বলতে চেয়ে আমার এই বেঁচে থাকা/ সেই কথা হলো আমি ভালোবাসি তোমাকে/ আমি ভালোবাসি তোমাকে/ তোমাকে.....'
গানটি শুনলে মনে হয় এটি নিছক প্রেমের কোনো গান নয়। এটি আসলে মুক্তির গান। মা কিংবা বাবার না বলা কথা তাদের ঔরসজাত সন্তান বলবে। এভাবেই ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষ বলবে তাদের না বলা কথা। আর এভাবেই একদিন মুক্ত হবে মানুষ।
তাই মনোসরণি বর্তমানে আর ব্যান্ড হিসেবে না থাকলেও আমাদের হৃদয়ে রয়ে গেছে তাদের গান দিয়ে। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো তাদের সেলফ টাইটেলড অ্যালবাম 'মনোসরণি' তীব্রভাবে প্রাসঙ্গিক। যতদিন মানুষ সিস্টেমের অধীনে দাস হয়ে থাকবে, যতদিন তার অস্তিত্বের সংকট থাকবে, যতদিন সে নিজেকে খুঁজে ফিরবে; আর সর্বোপরি, যতদিন পৃথিবীতে ভালোবাসা বলে কোনো শব্দ থাকবে, ততদিন প্রাসঙ্গিক হয়ে থেকে যাবে এক যুগ আগে প্রকাশিত কাল অতিক্রমী অ্যালবাম 'মনোসরণি।'
পাঠকের মন্তব্য
আপনার মতামত দিন
সাম্প্রতিক মন্তব্য (১)
সাকিব আহমেদ
২ দিন আগেখুব গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক প্রতিফলন দেখা গেছে। ধন্যবাদ!