১৮৯৭ সাল। কলকাতার রাজপথে ঘোড়ার গাড়ি চলছে, ধুলোর ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে নতুন এক কৌতূহলের ডাক—'পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! বায়স্কোপ! দেখুন জীবন্ত ছবি!'
হ্যান্ডবিলের সেই আহ্বান যেন ইতিহাসের প্রথম চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপনই বটে। তখনো কেউ জানে না, এই শহর থেকেই একদিন জন্ম নেবে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের প্রথম আলো, যার নাম হীরালাল সেন।
সে সময় কলকাতা যেন এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণ পেরোচ্ছে। মিনার্ভা থিয়েটারে মিস্টার সুলিভান তার 'অ্যানিমাটোগ্রাফ'-এর জাদু দেখাচ্ছেন; স্টার থিয়েটারে চলছে স্টিভেনসন সাহেবের বায়স্কোপ প্রদর্শন। দর্শকরা চোখ মেলে দেখছে—মানুষ আর জীবজন্তু নড়ছে, হাঁটছে, দৌড়চ্ছে! জীবন্ত ছবির এই জাদুতে মুগ্ধ হয়ে গেলেন এক তরুণ বাঙালি, মানিকগঞ্জের ছেলে, নাম হীরালাল সেন।
কিন্তু তার কৌতূহল ছিল অন্যরকম। তিনি শুধু দর্শক হতে চাননি—চেয়েছিলেন সেই জাদুর ভেতরে প্রবেশ করতে, নিজের হাতে আলো-ছায়া দিয়ে গল্প বলতে।
১৮৬৮ সালের ২ আগস্ট ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার বগজুরি গ্রামে জন্ম হীরালালের। পিতা চন্দ্রমোহন সেন ছিলেন ঢাকা জেলা কোর্টের আইনজীবী, পরবর্তীতে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন স্নেহশীলা, আবার সন্তানের কৌতূহলে উৎসাহদাত্রী।
হীরালালের ছেলেবেলা কেটেছে দীনেশচন্দ্র সেনের (পরবর্তীকালে খ্যাতনামা সাহিত্যিক) সঙ্গেই—পিসতুতো ভাই, বন্ধুও বটে। সেই দীনেশ একদিন কাগজ কেটে মানুষ-ঘোড়া বানিয়ে প্রদীপের আলোয় তাদের ছায়া বড় করে দেয়ালে ফেলে ছায়ানাট্য দেখিয়েছিলেন। শিশুহৃদয়ে সে ছিল নিছক খেলা, কিন্তু হীরালালের মনে তা রেখে গেল এক আজীবন অঙ্কিত ছাপ—আলো আর ছায়া দিয়েও যে জগৎ গড়া যায়!
কলকাতায় এসে তিনি স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা শুরু করলেও, বই নয়—ক্যামেরাই তাকে বেশি টানত। একসময় মায়ের কাছ থেকে ধার নেওয়া পাঁচ হাজার টাকায় কিনে ফেললেন ক্যামেরা, লেন্স, আর কিছু ফটোগ্রাফির সরঞ্জাম।
এইভাবেই জন্ম নিল তার স্টুডিও—এইচ. এল. সেন অ্যান্ড ব্রোস, ১৮৯০ সালে। ছবির পেছনে থাকত ফুল, পাখি, আর লেখা—'Photographed by Hiralal Sen & Brothers, Amarabaty Fine Art Association, Bogjury, Manikgonj.'
বাঙালির মধ্যে তখনই ছড়িয়ে পড়ল এই তরুণের নাম, তার তোলা প্রতিটি ছবি যেন আলোয় লেখা কবিতা।
যখন স্টিভেনসন সাহেব কলকাতায় বায়স্কোপ দেখানো শুরু করলেন, হীরালাল তখন নিয়মিত স্টার থিয়েটারে যেতেন। সাহেবের সঙ্গে গল্প করতেন, প্রশ্ন করতেন, কিন্তু সাহেব কখনো শেখাতেন না যন্ত্রের গোপন রহস্য।
তবু হীরালাল হাল ছাড়েননি। চোখে-চোখে দেখে, প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে শুনে—তিনি যেন হয়ে উঠলেন চলচ্চিত্রের এক একলব্য।
হঠাৎ একদিন সুযোগ এলো—এক মার্কিন ব্যবসায়ী তার পুরোনো প্রোজেক্টর বিক্রি করতে চাইলেন। হীরালাল মায়ের টাকায় কিনে নিলেন সেই যন্ত্র। আর সেই প্রোজেক্টর দিয়েই শুরু হলো ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ইতিহাস।
১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল, ক্লাসিক থিয়েটারে তিনি প্রথমবারের মতো প্রোজেক্টরে ছবি দেখালেন। এভাবেই নাম উঠল 'রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি'-র—উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনী সংস্থা।
সেই সময় কলকাতায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল কেবল রাজভবন আর হাওড়া ব্রিজে। তাই ছবির আলো জ্বলত গ্যাসে, অক্সিজেনভরা রবার ব্যাগে। একদিন সেই ব্যাগ ফেটে গেল—সব আলো নিভে গেল।
তখন সাহায্যের হাত বাড়ালেন ফাদার লাফোঁ, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পদার্থবিদ্যার এক অধ্যাপক। তিনিই পরামর্শ দিলেন স্টিলের ট্রাঙ্ক বানাতে, যাতে আর ছিদ্র না হয়। সেই থেকেই সিনেমার আলো আবার জ্বলে উঠল।
এই একাগ্রতা, এই পরিশ্রমই হীরালাল সেনকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছিল। তিনি ছিলেন একাধারে প্রযুক্তিবিদ, শিল্পী ও স্বপ্নদ্রষ্টা।
তবে শুধু বায়োস্কোপ দেখিয়ে মন ভরছিল না হীরালালের। তিনি ভাবলেন—চলমান ছবি যদি গল্প বলতে পারে? এই ভাবনা থেকেই শুরু হলো তার পরবর্তী অভিযান।
থিয়েটারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, অর্ধেন্দুশেখরের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন—তাদের নাটকের দৃশ্য ক্যামেরায় তুলতে চান। সবাই ফিরিয়ে দিলেন।
তখন এগিয়ে এলেন ক্লাসিক থিয়েটারের অমরেন্দ্রনাথ দত্ত। হীরালাল ও অমরেন্দ্রনাথ মিলে প্রথমবার 'ভ্রমর' নাটকের অংশ ধারণ করলেন ক্যামেরায়—বঙ্কিমচন্দ্রের 'কৃষ্ণকান্তের উইল'-এর নাট্যরূপ।
১৯০১ সালের অমৃতবাজার পত্রিকায় সেই প্রদর্শনের খবরও ছাপা হয়। সেখানে তারা 'আলিবাবা' নাটকের দৃশ্যও ধারণ করেন—যেখানে দূরের পাহাড় ধীরে কাছে আসে, গুহা খুলে দস্যুরা বেরিয়ে আসে, আলিবাবা প্রবেশ করে—আর পর্দা কালো হয়ে যায়।
এই চিত্রায়ন তখনকার ইউরোপ-আমেরিকার চলচ্চিত্রের কৌশলকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল—লং শট, ক্লোজ শট, প্যানিং—সবই ছিল তার জাদুকরী হাতের উদ্ভাসন।
১৯০০ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে হীরালাল যতগুলো চলচ্চিত্র ধারণ করেন, তার তালিকা আজও বিস্ময় জাগায়—'ভ্রমর', 'আলিবাবা', 'হরিরাজ', 'দোললীলা', 'সীতারাম', 'মৃণালিনী', 'বুদ্ধ', 'সোনার স্বপ্ন'…
একদিকে নাট্যচিত্র, অন্যদিকে সংবাদচিত্র—দিল্লির করোনেশন দরবার, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের লাঠিচার্জ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মিছিল—সবই তার ক্যামেরায় বন্দি। সে সময় বানিয়েছিলেন 'Grand Patriotic Film', যা রাজরোষের কবলে পড়ে।
এমনকি তিনি প্রথম তৈরি করেন বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনচিত্রও—'জবাকুসুম তেল' ও 'সালসা পিলা'র বিজ্ঞাপনচিত্র। সেই ছবির পর পণ্যগুলোর বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল বহু গুণ! তাই তাকেই বলা চলে ভারতের প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা।
হীরালালের তখন দারুণ সময় চলছে। সাফল্য এলো, পুরস্কার এলো—মোহন মেলা ও নিখিল ভারত শিল্প প্রদর্শনীতে স্বর্ণপদক পেলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন 'শো হাউস', যেখানে নিয়মিত সিনেমা দেখানো হতো।
কিন্তু জীবনের পর্দায় নেমে এলো অন্ধকার। ম্যানেজার রামলাল দত্ত তার সঙ্গে প্রতারণা করে সিনেমা হলটি নিজের নামে করে নিলেন।
এরপর ভাই মতিলালের সঙ্গে পারিবারিক বিরোধে ভেঙে গেল 'রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি'। দুই ভাই আলাদা হলেন, যেন ভাগ হয়ে গেল এক স্বপ্নও। এর ভেতরই হীরালাল বানালেন 'ভিজিট ফিল্ম' ,যা সরকারি প্রজেক্ট হওয়া সত্ত্বেও মুক্তির মাত্র দুদিন পরই সরকারবিরোধী বক্তব্যের জন্য সরকারই নিষিদ্ধ করে!
বিধির লীলা এখানেই থামেনি। হীরালালের শরীরে বাসা বাঁধল ক্যানসার। সংসার চালাতে প্রিয় ক্যামেরাগুলো বিক্রি করে দিতে হলো। অবশ্য পান্না মল্লিক তাকে এমনিতেই টাকাগুলো দিতে চেয়েছিলেন, ক্যামেরা নিতে চাননি। তবে হীরালাল চাইছিলেন এগুলো এমন কারো কাছেই থাকুক, যিনি অন্তত এর কদর বুঝবেন। হীরালাল মিতব্যয়ী ছিলেন না। তখন শরীর ভেঙে পড়েছে, সঞ্চয় নেই। দুই ভাইয়ের আলাদা হওয়ার সুবাদে সেই জায়গায় উঠে এলেন পারসি ব্যবসায়ী জামশেদজি ফ্রামজি ম্যাডান।
জীবনের অন্তিম পর্বে হীরালাল কাজ নিলেন নারায়ণচন্দ্র বসাকের 'লন্ডন বায়োস্কোপ' কোম্পানিতে উপদেষ্টা হিসেবে। কখনো ছবির প্রতিলিপি আঁকতেন, কখনো দেবদেবীর প্রতিকৃতি আঁকতেন—জীবনটাকে টিকিয়ে রাখার তাগিদে। তীব্র দারিদ্র্যের মাঝেও একদা বেপরোয়া হীরালালের জীবনে বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে ছিলেন তার স্ত্রী হেমাঙ্গিনী দেবী।
১৯১৭ সালের ২৪ অক্টোবর, দুর্গাপূজোর মহানবমীর দিন। রায়বাগানে মতিলাল সেনের বাড়িতে হঠাৎ আগুন লাগে। সেই আগুনে প্রাণ হারান মতিলাল সেনের বড় মেয়ে অমিয়বালা। পুড়ে যায় হীরালাল সেনের সমস্ত চলচ্চিত্র, নেগেটিভ, কষ্টার্জিত ইতিহাস। সেই আগুনে যেন পুড়ে গেল ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রারম্ভিক অধ্যায়ও।
পাঁচদিন পর, ২৯ অক্টোবর (মতান্তরে ২৬ অক্টোবর) ব্ল্যাকি স্কয়ারের বাড়িতে নিঃশব্দে নিভে গেল হীরালাল সেনের জীবনপ্রদীপ। মৃত্যুর সময় পাশে ছিলেন পরিবারের সদস্যরা ও তার বন্ধু ও অনুজপ্রতীম কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। রেখে গেলেন স্ত্রী হেমাঙ্গিনী দেবী, চার কন্যা ও এক পুত্র, আর রেখে গেলেন বিস্মৃতির এক বিপুল উত্তরাধিকার। হীরালালের মৃত্যুর পর তার পুরো পরিবারের দায়িত্ব নেন তার ভাই দেবকীলাল।
মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে ১০৮ বছর। তবু আজও হীরালাল সেনের নাম অনেকের অজানা। অথচ তিনি ছিলেন—উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শক, প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা, প্রথম সংবাদচিত্র নির্মাতা এবং বহু মতানুসারে প্রথম কাহিনিচিত্র পরিচালক।
অথচ, আমরা তাকে ভুলে গেছি, তার ছবিগুলো হারিয়েছে আগুনের লেলিহান শিখায়, আর তার নামটি পড়ে আছে ইতিহাসের পাতার এক প্রান্তে। কিন্তু সিনেমার পর্দায় যখন আলো জ্বলে ওঠে, আর ছায়া নড়ে ওঠে জীবন্ত হয়ে—তখন প্রতিটি মুহূর্তে হীরালাল সেন যেন অদৃশ্যভাবে সেখানে উপস্থিত থাকে।
কারণ, তিনিই প্রথম প্রমাণ করেছিলেন, আলো আর ছায়া মিলেই গল্প বলে, আর সেই গল্পই একদিন ইতিহাস হয়ে ওঠে।
পাঠকের মন্তব্য
আপনার মতামত দিন
সাম্প্রতিক মন্তব্য (১)
সাকিব আহমেদ
২ দিন আগেখুব গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক প্রতিফলন দেখা গেছে। ধন্যবাদ!