বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটকের রাজশাহীর যে বাড়িটিতে একসময় প্রাণের সঞ্চার ছিল, হাসি-কান্না-স্বপ্নের পদচিহ্ন ছিল—সেই পৈতৃক নিবাসটি আজ কেবলই এক নীরব ধ্বংসস্তূপ।

দেয়ালে বয়সের গভীর দাগ, ঘরজুড়ে আগাছার নিঃশব্দ রাজত্ব, আর সময়ের ধুলোয় মিশে থাকা বিস্মৃত স্মৃতির গন্ধ—সব মিলিয়ে যেন সময়ের এক নিঃসঙ্গ শোকগাথা। আগামীকাল এই অনন্য চলচ্চিত্রকারের জন্মের শতবর্ষ পূর্তি, অথচ তার শৈশব-যৌবনের আশ্রয়স্থলটি আজ দাঁড়িয়ে আছে অবহেলার অন্ধকারে।

রাজশাহীর মিয়াপাড়ার ঘোড়ামারা এলাকায় ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি এখন যেন সুদূর অতীতের স্মারক। খোলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাল ইটের স্তূপ, শ্যাওলায় মোড়া ভাঙা প্রাচীর, আর ভগ্নদেহের টুকরো টুকরো অংশে লেগে আছে কত না যুগের ব্যথা!
 

ফাটা দেয়ালের গায়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কিছু দেয়ালচিত্র, যার একটি ঋত্বিক ঘটকের জন্মবার্ষিকীর স্মারক। এগুলোই যেন শেষবারের মতো মনে করিয়ে দেয়, এখানে একসময় জন্ম হয়েছিল সৃষ্টিশীল একটি মনের।

ভগ্নদশায় থাকা এই বাড়িটিকে গত বছর ভেঙে ফেলা হয়। এখন শুধু আছে কিছু ইটের স্তূপ আর অতীতের স্মৃতির ভগ্নাংশ। অন্যতম মেধাবী বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের শৈশব স্মৃতির নীরব সাক্ষী এই বাড়ি।

১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া ঋত্বিক ঘটক শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছিলেন এই রাজশাহীতেই। তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করেন। দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালে তার পরিবার ভারতে পাড়ি জমালে বাড়িটি জেলা প্রশাসন "অর্পিত সম্পত্তি" হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।

১৯৮৫ সালে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই ইজারাকৃত ওই জমিটি কিনে নেয়। তবে ভবনটি তারপরও অক্ষত অবস্থায় টিকে ছিল বহু বছর।

কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আনিসুর রহমান বলেন, 'আমরা কখনোই চাইনি ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটা ভেঙে ফেলা হোক। আমরা এটাকে হাসপাতালের বহির্বিভাগ হিসেবে ব্যবহার করতাম। একদল সাবেক শিক্ষার্থী ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু আমরা তাদের নিষেধ করেছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এক সন্ধ্যায় তারা আমাদের না জানিয়ে ভেঙে ফেলে। তবুও প্রতি বছরের মতো এবারও ঋত্বিক ঘটকের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সেখানে অনুষ্ঠান হবে।'

ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি আহসান কবির লিটন বলেন, 'ঋত্বিক ঘটক তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন রাজশাহীতে। এখানকার পরিবেশ ও সংস্কৃতি তার চলচ্চিত্র ভাবনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পদ্মা নদী, বরেন্দ্র জাদুঘর, এমনকি পাশের পাবলিক লাইব্রেরি—সবকিছুই তার সংবেদনশীলতাকে গড়ে তুলেছিল।'

তিনি আরও জানান, '২০০৮ সালে আমরা যখন এই ফিল্ম সোসাইটি গঠন করি, তখন অনেকেই জানতেন না যে ঋত্বিক ঘটক রাজশাহীতে থেকেছেন। আমরা তার পৈতৃক বাড়ি থেকেই অনুষ্ঠান ও উৎসব শুরু করি এবং ২০০৯ সালে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখি "ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি"।

লিটন স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'ওই বাড়িটিতে একসময় ছিল ড্রয়িংরুম, শোবার ঘর, উঠান ও একটি পুরনো কূপ। এরশাদ সরকারের আমলে ওই ফাঁকা জমিতেই হোমিওপ্যাথিক কলেজ স্থাপন করা হয়। আমরা বাড়িটি সংরক্ষণের দাবি তুলেছিলাম, এমনকি প্রশাসনের কাছ থেকে সংস্কারের আনুমানিক ব্যয় ৫২ লাখ টাকার হিসাবও পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই উদ্যোগ আর বাস্তবায়িত হয়নি।'

তিনি জানান, একসময় ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন তাদের বাড়িটি ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন এবং শৈশবের নানা স্মৃতিচারণ করেছিলেন। তখনো বাড়িটি দাঁড়িয়ে ছিল। 'এখন সেটা না থাকাটা সত্যিই হৃদয়বিদারক,' বলেন লিটন।

তিনি আরও বলেন, 'রাজশাহীর সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সঙ্গে ঋত্বিকের শৈশবের পরিচয় তার চলচ্চিত্রচিন্তায় গভীর ছাপ ফেলেছিল। "অযান্ত্রিক" সিনেমায় তিনি গাড়ির গল্পের মাধ্যমে ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন, যেখানে ভারতীয় সিনেমা তখনও পৌরাণিক কাহিনিতে সীমাবদ্ধ ছিল। তার ভাবনা সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল।'

ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদ প্রতি বছর ৪ নভেম্বর তার জন্মবার্ষিকী উদযাপন করে। 'তবে এবার আর বাড়িটি নেই।' বলেন লিটন। 'তবুও আমরা আশা রাখি, একদিন এই স্থানটিকে তার স্মৃতিরক্ষায় একটি জাদুঘর বা চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউটে পরিণত করা হবে।'

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন বলেন, 'আমরা অনেকদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি যেন ঋত্বিক ঘটকের নামে এখানে কিছু প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের সহযোগিতায় আমরা নথিপত্রে পাই যে জমিটির মূল মালিক ছিলেন ঋত্বিক ঘটকের মা ইন্দুবালা দেবী। কলেজ কর্তৃপক্ষ সরাসরি মালিকানা দাবি করতে পারে না—এরশাদ সরকারের সময় জমিটি শুধু ইজারা দেওয়া হয়েছিল।'

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটির মডারেটর অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেন বকুল বলেন, 'ভবনটি ভেঙে ফেলার পর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তারা ইজারার জমিটি নিজেদের নামে নথিভুক্ত করে কলেজের সম্পত্তি হিসেবে দাবি করছে।'

এ বিষয়ে কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) টুকটুক তালুকদার বলেন, 'যখন ভবনটি ভাঙা হয়, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তাই পুরো বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। মালিকানা ও ভাঙার প্রসঙ্গটি অধ্যক্ষই ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন।'

এতকিছুর পরও যারা ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতি বুকে ধারণ করেন, তারা এখনও তার নাম ও কাজকে জীবিত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের কাছে রাজশাহীর সেই ধ্বংসাবশেষ শুধু ভাঙা ইট-পাথর নয়। এটি এক চলচ্চিত্রপ্রতিভার জন্মভূমির শেষ নিদর্শন—যিনি একদিন ভারতীয় ও বাংলা সিনেমার ধারা বদলে দিয়েছিলেন।