হ্যালোইন এলে আমরা প্রায়ই সেই পুরোনো ছবিগুলোই দেখি—হোকাস পোকাস, ইন্টারভিউ উইথ দ্য ভ্যাম্পায়ার, হ্যালোইন, দ্য ডিসেন্ট—এগুলো ক্লাসিক, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই হরর ঘরানার বাইরেও আছে এমন কিছু সিনেমা, যা কেবল ভয় দেখায় না, ভাবায়ও। এসব চলচ্চিত্রে ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকে সমাজ-রাজনীতি, অস্তিত্ব আর ক্ষমতার প্রতীকী ভাষা। একদিকে যেমন তারা নান্দনিক, অন্যদিকে তেমনই কাঁপিয়ে দেয় হৃদয়।
এমনই কিছু সিনেমার কথা তুলে ধরা হলো, যেগুলো দেখার পর শুধু গায়ে কাঁটা দেবে না, মনে প্রশ্নও জাগাবে।
হোয়াট উই ডু ইন দ্য শ্যাডোস (২০১৪)
টাইকা ওয়াইতিতি ও জেমেইন ক্লেমেন্টের অদ্ভুত রসবোধে ভরা এই মকুমেন্টারি যেন ভ্যাম্পায়ার ঘরানার বুক চিরে নতুন প্রাণ ঢেলে দিয়েছে। ওয়েলিংটনে বসবাসরত কয়েকজন প্রাচীন ভ্যাম্পায়ার রুমমেটের (ওয়াইতিতি, ক্লেমেন্ট, জোনাথন ব্রুহ ও বেন ফ্রানশাম) নিত্যদিনের অদ্ভুত জীবন—ঘর পরিষ্কার, পার্টি, আর শতাব্দীর একঘেয়েমি। এখানে রক্তচোষাদের দেখা যায় উপনিবেশবাদ, পুরুষতন্ত্র ও প্রবাসী পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে—যারা সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নিজেরাই হারিয়ে ফেলেছে নিজস্বতা। হাস্যকর, রক্তাক্ত, অথচ মর্মস্পর্শী—এই ছবিটিই পরবর্তীতে এক কাল্ট টিভি সিরিজের জন্ম দেয়।
অনলি লাভারস লেফট অ্যালাইভ (২০১৩)
জিম জারমুশ এই ছবিতে ভ্যাম্পায়ার মিথকে রক'ন রোল ছোঁয়ায় নতুন আঙ্গিকে হাজির করেছেন। টিলডা সুইনটন ও টম হিডলস্টন অভিনীত যুগল শতাব্দীপ্রাচীন প্রেমিক-প্রেমিকা, যারা ডেট্রয়েট ও তানজিয়ারে শিল্প, সংগীত আর অস্তিত্ব সংকটের ভেতর দিয়ে টিকে আছে। রক্তপিপাসার চেয়ে ছবিটি বেশি কথা বলে সৃজনশীলতা, ক্ষয় ও চিরস্থায়ী ভালোবাসা নিয়ে। স্বপ্নময়, বিষণ্ণ এবং গভীর—এক নিঃসঙ্গ অক্টোবর রাতের জন্য একদম উপযুক্ত।
আ গার্ল ওয়াকস হোম অ্যালোন অ্যাট নাইট (২০১৪)
আনা লিলি আমিরপুরের প্রথম ছবিটি পরিচিত 'প্রথম ইরানি ভ্যাম্পায়ার ওয়েস্টার্ন' হিসেবে। সাদা-কালো এই কল্পশহর 'ব্যাড সিটি'-তে এক চাদর পরা রহস্যময় নারী ভ্যাম্পায়ার (শীলা ভ্যান্ড) ঘুরে বেড়ান, যে নারীদের ওপর অত্যাচার করা পুরুষদের শিকার করে। নীরব সংলাপ, দারুণ সাউন্ডট্র্যাক আর ওয়েস্টার্ন ধাঁচের সিনেমাটোগ্রাফি মিলিয়ে এটি ভয়, শিল্প আর সামাজিক প্রতিবাদের মিশ্রণ—হ্যালোইনের অপরিহার্য এক রীতিমতো আচারস্বরূপ চলচ্চিত্র।
টুয়েন্টি এইট ডেইজ লেটার (২০০২)
ড্যানি বয়েলের এই পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপটিক ছবি নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিল জম্বি ঘরানাকে। অ্যালেক্স গারল্যান্ডের লেখা চিত্রনাট্যে সিলিয়ান মারফি জেগে ওঠেন এক ধ্বংসপ্রাপ্ত লন্ডনে, যেখানে এক 'রেজ ভাইরাস' সমাজকে গিলে ফেলেছে। জম্বিদের উন্মত্ততা এখানে প্রতীক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, সামরিকতা ও সভ্যতার ভঙ্গুরতার। ভয়াবহ, গতিময় ও আশ্চর্যরকম ভবিষ্যতদ্রষ্টা এই ছবি হররকে ফের জরুরি করে তুলেছিল। আর ভালো লাগলে এর সিক্যুয়েলগুলোও দেখতে পারেন।
ট্রেন টু বুসান (২০১৬)
ইয়ন সাং-হো পরিচালিত এই দক্ষিণ কোরিয়ান ছবি একসঙ্গে শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলার ও সমাজতাত্ত্বিক রূপক। প্রায় পুরোটা সময় এক হাই-স্পিড ট্রেনে বন্দি, যেখানে স্কুইড গেম–এর গং ইউ একজন কর্মপাগল পিতার চরিত্রে—মেয়েকে রক্ষা করতে ছুটছেন, যখন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে জম্বি-আতঙ্ক। সীমিত স্থানের ভেতর চরিত্রগুলোর প্রতিটি সিদ্ধান্ত—আত্মত্যাগ থেকে স্বার্থপরতা—হয়ে ওঠে নৈতিক পরীক্ষা। শ্রেণিবৈষম্য ও মানবিকতার দ্বন্দ্বে এটি এক করুণ অথচ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ছবি।
পন্টিপুল (২০০৮)
কানাডার এই কাল্ট ছবি একেবারেই আলাদা—এখানে ভাইরাস ছড়ায় কথার মাধ্যমে। ব্রুস ম্যাকডোনাল্ড পরিচালিত ও টনি বার্জেসের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি এই চলচ্চিত্রে এক স্থানীয় রেডিও হোস্ট (স্টিফেন ম্যাকহ্যাট্টি) আটকা পড়েন যখন ভাষাই হয়ে ওঠে সংক্রমণের মাধ্যম। প্রায় এক ঘরেই শুটিং করা এই মিতব্যয়ী ভয়াবহতায় ফুটে ওঠে গণমাধ্যম, যোগাযোগ ও ভাষার শক্তি। 'শব্দই মৃত্যু'—এই ধারণায় তৈরি ছবিটি বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যতিক্রমী ও সময়ের সীমা ছাড়ানো।
প্যান'স ল্যাবিরিন্থ (২০০৬)
গিলের্মো দেল তোরোর এই ডার্ক ফ্যান্টাসি আসলে রাজনৈতিক উপকথা। ফ্যাসিবাদী স্পেনে এক কিশোরী অফেলিয়া (ইভানা বাকেরো) আবিষ্কার করে এক রহস্যময় গোলকধাঁধা, যেখানে পৌরাণিক প্রাণীরা তাকে পথ দেখায়; অন্যদিকে তার সৎপিতা, এক নির্মম সেনা কর্মকর্তা, চালাচ্ছেন ফ্রাঙ্কো শাসনের ভয়াবহতা। কল্পনার জগৎ আর বাস্তব সহিংসতার এই দ্বন্দ্বে ছবিটি মনে করিয়ে দেয়—দানবরা কেবল গল্পে থাকে না, ইতিহাসেও থাকে।
দ্য মিস্ট (২০০৭)
স্টিফেন কিংয়ের গল্প অবলম্বনে ফ্র্যাঙ্ক দারাবন্ট নির্মাণ করেছেন এক বাস্তববাদী হরর সিনেমা। এক শহরে রহস্যময় কুয়াশা নেমে আসে, যার আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর প্রাণী। কিন্তু প্রকৃত আতঙ্ক জন্ম নেয় মানুষের ভেতর—ভয় থেকে জন্ম নেয় ধর্মীয় উন্মত্ততা, একে অন্যের প্রতি সহিংসতা। টমাস জেনের নেতৃত্বে অভিনেতাদের অসাধারণ পারফরম্যান্সে এই ছবির শেষ দৃশ্য—সম্ভবত হরর ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ ও অম্লান সমাপ্তিগুলোর একটি—সতর্ক করে দেয়, আসল দানব অনেক সময় মানুষের ভেতরেই বাস করে।
কলোসাল (২০১৬)
অন্যরকম ঘরানার এই ছবি একাধারে কাইজু মনস্টার মুভি, আবার মাদকাসক্তি ও নির্যাতনের প্রতীকী গল্পও। অ্যান হ্যাথাওয়ে অভিনীত গ্লোরিয়া একদিন আবিষ্কার করে, সিউলে তাণ্ডব চালানো এক বিশাল দানবের সঙ্গে তার মানসিক সংযোগ রয়েছে। শুরুতে মজার মনে হলেও গল্প ক্রমে রূপ নেয় ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ আর পুরুষ অহংকারের সমালোচনায়। জেসন সুডেকিসের চরিত্র ছবিটিকে দেয় এক ভয়ংকর গভীরতা। খেলাচ্ছলে শুরু হলেও এর বার্তা তীক্ষ্ণ ও হৃদয়বিদারক।
দ্য ভিলেজ (২০০৪)
এম নাইট শ্যামলনের এই চলচ্চিত্র তার সবচেয়ে ভুল বোঝা কাজগুলোর একটি। এখানে ভয়টা দানব নয়, বরং সমাজের শাসনের কৌশলে। এক বিচ্ছিন্ন গ্রামবাসী বিশ্বাস করে, তাদের চারপাশের জঙ্গলে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর প্রাণী, যা আসলে শাসকদের তৈরি এক মিথ। ব্রাইস ডালাস হাওয়ার্ড, জোয়াকিন ফিনিক্স ও সিগোরনি উইভারের অভিনয়ে তৈরি এই গল্প ভয় নয়, বরং ক্ষমতা, নিরাপত্তা আর বিচ্ছিন্নতার মূল্যে নিয়ে গভীর এক ভাবনা জাগায়।
দ্য ক্রাফট (১৯৯৬)
নব্বইয়ের দশকের এই টিন ক্লাসিক ছবিটি কেবল কালো পোশাক, মোমবাতি আর জাদুর ফ্যাশন নয়—এটি নারী ক্ষমতা, বুলিং ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিপদ নিয়ে তীক্ষ্ণ মন্তব্য। রবিন টুনি, ফেরুজা বল্ক, নেভ ক্যাম্পবেল ও র্যাচেল ট্রু একত্রে গড়েছেন এক নারী-চক্র, যাদের বন্ধন ভেঙে যায় যখন জাদু বাড়িয়ে দেয় তাদের অন্তর্নিহিত অন্ধকার। তরুণ নারীদের কেন্দ্র করে এমন গল্প, যেখানে পরিচয়, বর্ণবাদ ও বিদ্রোহ মিলেমিশে গেছে—তখনকার সিনেমায় তা ছিল যুগান্তকারী। আর বল্কের চরিত্র? পর্দায় এত শীতল, অথচ এত শক্তিশালী জাদুকরী আর দেখা যায়নি।
দ্য লাভ উইচ (২০১৬)
আনা বিলারের তৈরি এই ছবি যেন ষাটের দশকের রঙিন পোস্টকার্ডে লুকোনো এক বিষবিন্দু। সামান্থা রবিনসন অভিনীত এলেইন—এক আধুনিকা জাদুকরী, যে প্রেম খুঁজতে খুঁজতে ব্যবহার করে মন্ত্র ও ওষুধ। চকচকে রঙ আর কৌতুকের আড়ালে এখানে তীক্ষ্ণ সমালোচনা আছে নারী-পুরুষ সম্পর্ক, আকর্ষণ আর সমাজের প্রত্যাশা নিয়ে। মজাদার অথচ রাজনৈতিকভাবে প্রখর—এটি নারীবাদী হরর সিনেমার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
সাসপিরিয়া (১৯৭৭)
দারিও আরজেন্তোর ক্লাসিক সাসপিরিয়া তার রঙ, শব্দ ও ভয়াবহ নৃত্যের জন্য যেমন বিখ্যাত, তেমনি নারীবাদী প্রতীকের দিক থেকেও তা শক্তিশালী। জেসিকা হারপার অভিনীত এক মার্কিন নৃত্যশিল্পী জার্মানির এক নৃত্য-একাডেমিতে ভর্তি হয়, পরে জানতে পারে এটি আসলে এক ডাইনি-চক্রের আস্তানা। প্রতিষ্ঠান ও নারীশরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণের প্রতীক হয়ে ওঠে এই গল্প। প্রায় ৫০ বছর পরেও এর রঙিন সহিংসতা ও প্রতীকী ভাষা ততটাই প্রাসঙ্গিক এবং অনুপ্রেরণামূলক।
এই ছবিগুলো কেবল ভয় দেখানোর জন্য নয়, বরং ভয় আর বাস্তবতার ফারাক মুছে দেওয়ার জন্য। হ্যালোইনের রাত হোক শুধু ভয় নয়—ভাবনারও।
পাঠকের মন্তব্য
আপনার মতামত দিন
সাম্প্রতিক মন্তব্য (১)
সাকিব আহমেদ
২ দিন আগেখুব গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক প্রতিফলন দেখা গেছে। ধন্যবাদ!