'কথা বেশি বলেন না কখনো। লেখার ক্ষেত্রেও তেমন মুক্তহস্ত নন। মন্তব্য প্রদানে অবশ্য সতত সুস্পষ্ট। সর্ষের মধ্যে ভূত সহজেই চোখে পড়ে তাঁর। রাতে বা দিনে যখনই যেখানে দেখেন, ফিলহাল ধরে ফেলেন চোখের নিমেষে।'

জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এভাবেই লিখেছিলেন কলিম শরাফীর ব্যাপারে। অল্পকথায় তুলে ধরেছিলেন তার ব্যক্তিত্বকে।

কলিম শরাফী—উদারহৃদয় এক শিল্পী, এক বিপ্লবী। জন্ম ১৯২৪ সালের ৮ মে বীরভূমে। বেশ ধার্মিক পরিবারের সন্তান। পুরো নাম মাখদুমজাদা শাহ সৈয়দ কলিম আহমেদ শরাফী। মাত্র চার বছর বয়সেই মাতৃবিয়োগ ঘটে তার, নানির স্নেহে, সান্নিধ্যে প্রতিপালিত হন।

তার জীবনের দুরন্ত অভিযাত্রা শুরু হয় কৈশোরেই, বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে মিলে। তারা দুজনেই ছিলেন কলকাতা মাদ্রাসার ছাত্র। তবে আলিম বা ফাজিল নয়, তারা ছিলেন সেখানকার ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। দশম শ্রেণির কিশোর কলিম শরাফী তখন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ডাকে অংশ নেন হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে। কংগ্রেসপন্থী ও মার্ক্সিস্ট বিভিন্ন দল এবং ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী ও মুসলিম ছাত্ররাও এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ফলে সুভাষ বসুর ফরওয়ার্ড ব্লকের আহ্বানে গড়ে উঠলেও হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলন সর্বাত্মক রূপ পরিগ্রহ করে।

ইসলামিয়া কলেজে আন্দোলনকারীদের একটি মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। তখন প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ড. জাকারিয়া, ছাত্রনেতা আব্দুল ওয়াসেক থেকে শুরু করে কলিম শরাফীসহ আরও অনেকেই আহত হন। এ সময় ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র তার সিনিয়র রফিকউদ্দিন ওরফে 'রফিক ভাইয়ের' সংস্পর্শে আসেন কলিম শরাফী। দীক্ষা নেন মার্কসবাদের। গোপন সংগঠনের সাংগঠনিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েন।

১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষজুড়ে ছড়িয়ে পড়া 'ভারত ছাড়' আন্দোলনেও অংশ নেন কলিম শরাফী। সে সময় তাকে প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে সিউড়ি জেলে রাখা হয়। জেলে থাকার সময় গ্রেপ্তার আরেক স্বদেশি আন্দোলনকারী প্রণব গুহঠাকুরতার সংস্পর্শে আসেন। তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাইতে শুরু করেন এবং ঠিক করেন শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করবেন।

১১ মাস জেলে ছিলেন কলিম শরাফী। জেল থেকে বেরোনোর পর তিনি আরও নিবিড়ভাবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৩ সালে গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএর সংগঠক হিসেবে তিনি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

তবে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় শান্তিনিকেতনে ভর্তি হতে পারেননি তিনি। এ সময় সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার পরিচয় ও যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তারা হয়ে ওঠেন সংগীতের 'সহজন'।

এর ভেতরই আত্মীয়দের অনুরোধে ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন তিনি। তবে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তা ছেড়ে দেন। মেডিকেলের কড়া নিয়ম-কানুন আর পড়ালেখার চাপ ভালো লাগেনি তার।

এর ভেতরই ঘটে গেল সেই ঘটনা। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আহ্বানে 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে' পালনের ডাক দেওয়া হয়। কলিম শরাফী গড়ের মাঠে তার বক্তব্য শুনতে যেতে চেয়েছিলেন। তবে তার আগেই দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। তার বন্ধু সমরেশ রায়ের পরামর্শে গিয়ে ওঠেন কিংবদন্তি রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়ি। তাকে দেখে উল্লসিত 'জর্জ দা' (দেবব্রত বিশ্বাসের ডাকনাম) বলে উঠেছিলেন: 'শালা বাঁইচা আছে!' 

জর্জ দা তাকে এক সপ্তাহ খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন৷ তারপর পরিস্থিতি শান্ত হলে পৌঁছে দেন মুসলিম স্কয়ারের বাড়িতে।

আইপিটিএর গণসংগীত চর্চা ও অন্যান্য কাজকর্মের পাশাপাশি কলিম শরাফী রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার জন্য ১৯৪৭ সালে শুভ গুহঠাকুরতা প্রতিষ্ঠিত সংগীত শিক্ষায়তন 'দক্ষিণী'তে যোগ দেন। তার আনুষ্ঠানিক রবীন্দ্রসংগীত প্রশিক্ষণ শুরু এখান থেকেই। শুরু জীবনের নতুন এক অধ্যায়।

১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথকে 'বুর্জোয়া কবি' আখ্যায়িত করেন সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক বি টি রণদীভে এবং একইসঙ্গে তাকে বর্জনের প্রস্তাব করেন। এর সঙ্গে দ্বিমত করে গণনাট্য থেকে অনেকেই বেরিয়ে যান, যার ভেতর অন্যতম কলিম শরাফী। তারা গড়ে তোলেন নাট্যদল 'বহুরূপী', যার প্রাণপুরুষ ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য ও শম্ভু মিত্র।

১৯৫০ সালে কলিম শরাফী ঢাকায় চলে আসেন। কলকাতায় যথেষ্ট কাজ পাচ্ছিলেন না। আরও কিছু সমস্যা ছিল। এখানে এসে ঢাকায় সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত সুকান্ত ভট্টাচার্যের 'অবাক পৃথিবী' গাইলেন। এর আগে ১৯৪৫ সালের দিকেই গণনাট্যে থাকার সময় সলিল চৌধুরী তার প্রথম গান 'কোনো এক গাঁয়ের বধূ' কলিম শরাফীকে দিয়ে রেকর্ড করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে কলিম তাকে গানটি দিয়ে দেন। 

এবারে সলিলের এই গান গেয়ে কলিম গোয়েন্দা সংস্থার রোষানলে পড়ে গেলেন। তার বাড়ি এসে তাকে সতর্ক করে যাওয়া হলো। তিনি নিরাপত্তার জন্য চট্টগ্রাম গেলেন। সেখানে কাজী আলী ইমামসহ আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুললেন 'প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ'।

১৯৫৪ সালের ২৩ থেকে ২৬ এপ্রিল ঢাকা কার্জন হলে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কলিম শরাফী তার 'প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ' নিয়ে সেই সম্মেলনে যোগদান করেন এবং গণসংগীত ও নাটক 'বিভাব' পরিবেশন করেন। কলিম শরাফীর পরিচালনায় সেখানে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশিত হয়।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার কুখ্যাত ৫২ (ক) ধারা জারি করার পর তাকে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকতে হয়। ১৯৫০ সাল থেকেই তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত ছিল। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর রেডিওতে তার গান প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। একসময় পেশাগত জায়গা থেকে কলিম শরাফী বেশ কিছু প্রচারণামূলক তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরিচালনা করেন 'সোনার কাজল' নামে একটি চলচ্চিত্র। সিনেমার গল্পটিও তারই লেখা।

কলিম শরাফীর শিল্পী হিসেবে পরিচিতি বেড়ে যায় ১৯৬২ সালে। সালাহউদ্দিন পরিচালিত 'সূর্যস্নান' সিনেমায় তিনি গান 'পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে'। আলমগীর জলিলের কথা ও খান আতাউর রহমানের সুরে এই গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো গাঢ়ত্ব ও মুকেশের মতো প্যাথোস—দুটোই সমানভাবে ছিল কলিম শরাফীর গলায়—যা শিল্পীদের ভেতর বিরল। তার দরদি কণ্ঠ গানটিকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে ও কালজয়ী করেছে।

১৯৬৪ সালে ঢাকা টেলিভিশন প্রতিষ্ঠিত তিনি অনুষ্ঠান প্রধান হিসেবে যোগ দেন। সে বছরই তার পরিকল্পনায় মুনীর চৌধুরী লেখেন নাটক 'একতলা দোতলা'। ১৯৬৭ সালে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়।

১৯৬৯ সালে সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্তের আমন্ত্রণে তিনি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীতে যুক্ত হন। এর আগে ১৯৬১ সালে মোখলেসুর রহমান সিধু মিয়ার বাড়িতে ছায়ানট প্রতিষ্ঠার জন্য হওয়া বৈঠক ও ১৯৬৭ সালে রমনা বটমূলে তাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানেও তিনি অংশ নেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার ও জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। পাশাপাশি উদীচীসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ১৯৭৬ সালে যথাযোগ্য মর্যাদায় একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা বিষয়ক বিবৃতিতে স্বাক্ষর করায় তাকে সামরিক সরকার চাকুরিচ্যুত করে।

১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্তর অবর্তমানে তিনি উদীচীকে গোটা দেশে ছড়িয়ে দেন। ১৯৭৬ সাল থেকে তার নির্দেশে উদীচী সারাদেশে মঞ্চস্থ করতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গীতি-আলেখ্য 'ইতিহাস কথা কও'। তার নেতৃত্বে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উদীচী স্মরণীয় ভূমিকা রাখে৷

এর ভেতরই ১৯৮৩ সালে প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি শান্তিনিকেতন থেকে সদ্য ফেরা শিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে 'সংগীত ভবন' নামে একটি গান ও নাচের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৮৫ সালে একুশে পদক ও ১৯৯৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার পান তিনি।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে কলিম শরাফী শেষবয়সে বেশকিছু রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেন, যা তার অনবদ্য গায়নশৈলীর প্রমাণ রেখে গেছে।

বয়সের কারণে একসময় সাংগঠনিক কাজ থেকে অবসর নেন। তবে সবসময়ই সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন সংস্কৃতিজনদের। অবসরে প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসতেন আর সবসময়ের সঙ্গী ছিল গান।

২০১০ সালের ২ নভেম্বর ৮৬ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন কলিম শরাফী। মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।

কলিম শরাফী প্রথাগত অর্থে হয়তো কোনো সেলিব্রেটি বা তারকা ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন 'নক্ষত্র'। একজন মাটির মানুষ, একজন প্রকৃত শিল্পী। এবং অতি অবশ্যই একজন বিপ্লবী। এভাবে গণপর্যায়ে শিল্পের বিস্তার ও সংস্কৃতি চর্চা করে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আর এর মাধ্যমে বাংলা সংগীত জগতে করে নিয়েছেন চিরস্থায়ী স্থান।

তার জীবনে নানা সময়ই ঝঞ্ঝা এসেছে। তবে শান্ত থেকে সব সামলেছেন। রবীন্দ্রনাথের সেই গানটিই প্রতিফলিত হয়েছে তার জীবনে: বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি/ বারে বারে হেলিস নে ভাই।